তবুও প্রেম জাগে
-শ্যামল কুমার মিশ্র
♦♦♦♦♦♦♦♦♦
একটু একটু করে অন্ধকার সরে যাচ্ছে
ঘুঘু পাখির নিরন্তর ডাক
তারি মাঝে উন্মোচিত হচ্ছে জীবনের নানা ছবি
ফেলে আসা অতীত যেন কথা কয়
মনে হয় যেন সব রূপকথা…
সেদিনও ঐ পেয়ারের ডালে বসে ছিল টিয়া
সবুজের আড়ালে ডেকেছিল তার প্রেমিকারে
জীবনের সৃষ্টি লাগি যেন এক নিরন্তর প্রয়াস
প্রবহমান জীবনের বার্তা নিয়ে
আজও আছে সেই গাছ
টিয়ারা হারিয়ে গেছে কোকিলেরে পথ ছেড়ে
প্রেম তবু জেগে থাকে
এক প্রাণ থেকে আর এক প্রাণে
ব্যক্তি মিশে গেলে
নতুন এক প্রাণ খুঁজে চলে প্রেম
সময় থেকে সময়ান্তরে
তবুও প্রেম জাগে…
♦♦♦♦♦♦♦♦♦
কবি পরিচিতি:
শিরোনাম: আমার কথা
কলমে: শ্যামল কুমার মিশ্র
১২-০২-২০২২
কোথা থেকে শুরু করব এমনটা ভাবতে ভাবতে যখন অনেকটা সময় কেটে গেছে তখন মেঠোপথের বাঁকে ছেলেটির সঙ্গে দেখা। সকালবেলা হন্তদন্ত হয়ে চলেছে প্রাইমারি স্কুলে। খুব যে আনন্দের সঙ্গে বিদ্যালয় গমন তা নয় কিন্তু মায়ের কড়া নির্দেশ– স্কুলে যেতেই হবে। ছেলেটির ভয় করে ঐ অঙ্কের মাস্টারমশাইকে। শুকনো চেহারা,হাফ হাতা বাংলা শার্ট, হাঁটুর উপর ধূতি– বিষয়ের কাঠিন্যের সঙ্গে চেহারার কাঠিন্য মিশে বিষয়টিকে ছাত্রের কাছে আরো কঠিন করে তুলেছিল। যদিও স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর ঐ কঠিন মাস্টারমশাই এর সঙ্গে এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।খুঁজে পেয়ে ছিল এই আপাত কাঠিন্যের অন্তরালের মানুষটিকে যা বড়ই কোমল,বড়ই স্নেহার্দ্র্য।
তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামের ঐ ছেলেটি প্রাইমারী ছাড়িয়ে ভর্তি হয় শতাব্দী প্রাচীন এক জাতীয় বিদ্যালয় কলাগেছিয়া জগদীশ বিদ্যাপীঠে যেখানে একসময়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ও চারণকবি মুকুন্দ দাসের পদার্পণ ঘটেছিল। হাজারো স্বপ্ন তখন ছেলেটির দুচোখে। স্কুলে থাকতে থাকতেই ছেলেটি আদর্শ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার হাতছানি থেকে সরে আসে ছেলেটি। আর তাই রসায়নে সাম্মানিক নিয়ে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হওয়া। স্কুল জীবনের লেখালেখির অভ্যাস এই আশ্রমিক পরিবেশে আরও শানিত হয়। এই আশ্রমিক জীবন ছেলেটির জীবনের এক বাঁক। আদর্শ ও শৃঙ্খলার ঘটল মেলবন্ধন। মহাবিদ্যালয়ের পাঠ শেষে বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজ থেকে প্রাণ রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর গবেষণায় রত হয় ছেলেটি কিন্তু বাধ সাধে দারিদ্র্য। গবেষণাগার থেকে উত্তর ২৪ পরগণার এক প্রান্তিক স্কুল কাটিয়াহাট বিকেএপি ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক। ইছামতির সঙ্গে সহবাস। প্রান্তিক এই স্কুল ছেলেটিকে দুই বাংলার মানুষদেরকে নতুন করে চিনতে শেখায়। দশ বছর পেরিয়ে আবার কলকাতায় ফেরা। এবারে যাদবপুরের এক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় যাদবপুর নবকৃষ্ণ পাল আদর্শ শিক্ষায়তনের প্রধান শিক্ষক হিসেবে এই প্রত্যাবর্তন। এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। এই দীর্ঘ পরিক্রমণের অপরাহ্ণ বেলায় শুরু হয় অতিমারি। আর তা যেন ফিরিয়ে দেয় নরেন্দ্রপুরের সেই পত্রিকা সম্পাদককে। আবার লেখা লেখি শুরু। তার লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বর্তমানে দেশে ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অফলাইন ও অনলাইনে প্রকাশিত। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থেকেই চাকুরিরত অবস্থাতেই বাংলাভাষায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আর একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ‘বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার’ আয়োজিত বিদ্যাসাগর বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন যা আজ বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে ছেলেটিকে বড় আনমনা করে তোলে। মনে পড়ে যায় বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সন্তোষ কুমার অধিকারী ও স্বামী প্রভানন্দ মহারাজের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ। লেখাপড়া আর ছাত্রদের নিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেছে। ২০১৮ তে আনন্দবাজার পত্রিকা ‘দ্রোণাচার্য্য’ সম্মানে সম্মানিত করে ছেলেটিকে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পাওয়া এই পুরস্কার ছেলেটির জীবনে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে।মূল্যবোধের অপহ্নবে ভুগতে থাকা মানুষজনের জন্য কষ্ট পায় ছেলেটি। তাই বিভিন্ন পেশার মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গড়ে তুলেছে ‘মনীষী চর্চা কেন্দ্র’। সঠিক বৈজ্ঞানিক মননে ঋদ্ধ আদর্শ মানুষ তৈরি যার মূল্য লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য পূরণে মানুষের জন্য “মনীষী চর্চা কেন্দ্র” দৌড়ে গেছে সাগর থেকে মেদিনীপুরে।
পূর্ব মেদিনীপুরের সেই গ্রামের ছাত্রটির পরিক্রমণ আজ ও অব্যাহত। প্রায় ৩৪ বছরের চাকুরী জীবন যার মধ্যে প্রায় ২২ বছর প্রধান শিক্ষকের কাজ শেষে আজ সদ্য অবসর নিয়েছে ছেলেটি। কিন্তু আজো স্বপ্ন দেখে আর সেই স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে রবিউল, প্রীতম, শর্মিষ্ঠা,অমিতরা আর প্রশ্ন করে ভালো আছেন স্যার? ছেলেটির চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।