গরীবের স্বপ্ন

-দীপঙ্কর সরদার 

⊂⊃⊂⊃⊂⊃⊂⊃⊂⊃

আর উত্তর দিতে পারল না নিতাই,এই কিছু সময়ের অভিজ্ঞতায় যেন সমাজের সব কিছু তার জানা হয়ে গেল,চিনে নিল ভদ্রবেশী মুখোশধারী মানুষেদের।

কাঁদতে লজ্জা করে নিতাইয়ের তাই কাঁদল না, দুহাতে মুখ চেপে ক্লান্ত হাঁটুর মধ্যে মিশিয়ে দিল তার লজ্জা, ঘৃণা, প্রতিহিংসা, দুঃখ কষ্ট, অনিদ্রা, অনাহার এমনকি শেষ একবিন্দু মান মর্যাদাও।

দুরন্ত চারচাকা গাড়ির বিষাক্ত রাসায়নিক ধোঁয়ায় ও শব্দে চেতনা ফিরল নিতাইয়ের,উঠে দাঁড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারল না। নিজের প্রতি ধিক্কার জানায় নিতাই,সমগ্ৰ সমাজ ও পরিবেশের সাথে সাথে নিজের দেহটা ও যেন তাঁর চিরশত্রু হয়ে ওঠেছে, অগত্যা ফুটপাতের খুঁটিটাই শেষ সম্বল।

বেশ খানিকটা চলার পরে অনুভব করে নিতাই, গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে,ঢোক মারতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে,ডান হাতের তালুতে এখনও পাঁচ টাকার কয়েন টা শক্ত করে ধরে আছে নিতাই, হতাশায় আলগা করে মুঠি,অস্তমিত সূর্যের ক্ষীণ আলোয় তখনও সোনালী পাঁচ টাকার কয়েন চক চক করছে,চক চক করবেই তো বদ্ধ তালুর দিশেহারা ঘাম যে জড়িয়ে রয়েছে তাতে।

মনে পড়ে যায় প্রাণধিক প্রিয় ছোট্টো বোনটির কথা, এতক্ষণে সে অবাক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছে অজানা জগতে।কানের পাশ দিয়ে ধেয়ে চলে যায় উৎসুক জনতা তীব্র উচ্ছাসের সমবেত কন্ঠস্বর পিছনে ফেলে চলে যায় সমাজের নৃৎকৃষ্ঠতম মানব নিতাই কে।

নীরবে হেসে উঠে নিতাই,ধুক ধুক করে ওঠে নিতাইয়ের জরাজীর্ণ পাঁজরে ঘেরা হৃৎপিণ্ডটা।

কত স্বপ্ন ছিল নিতাইয়ের,বিনি মাসির সেই কথাটা এখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নিতাইয়ের মনে,

-“কি জানি বাপু, ফুটপাতে শুয়ে কেন এত লম্বা চওড়া কথা কও তোমরা, গরীবের আবার স্বপ্ন টব্ন হয় না কি”?

-ঠিক তো গরীবের আবার স্বপ্ন টব্ন কি,আপন মনে বলে ওঠে নিতাই, এতদিন যেন সে কাঁচের দেয়ালের মধ্যে বহু যন্তে সাজিয়ে রেখেছিল কত মন গড়া স্বপ্ন, মূহুর্তের ঝড়ে যে সব চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে স্বপ্নে ও কল্পনা করতে পারেনি নিতাই,ভিক্ষারী সে নয় বুকের রক্ত তুলে খাটে ঠিকেদারের কাছে, ভিক্ষাবৃত্তি কে সে ঘৃণা করত, তবু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, নিজের সঞ্চিত অর্থ, বোনের সোনার গয়না এমনকি চড়া দরে সুদ নিয়েও যোগান দিতে পারল না অমূল্য ঔষধের, তাই শেষ রক্ষা করতে স্বজাতির মতো রাস্তায় হাত পাততে বাধ্য হল, কিন্তু তাঁর কাতরস্বরে কেউ সাড়া দিল না, অভিজ্ঞতা ও নিপুণ পদ্ধতির অভাবে অর্জিত অর্থ মাত্র পাঁচ টাকা।

-গঙ্গার তীরে এসে থামলো নিতাই, নিজের প্রতি ঘৃণায় ক্ষোভে চারিপাশের মাথা উঁচু করা রঙিন বিল্ডিং এর সামনে মাথা নোয়ালো সে, নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলনা গঙ্গার স্বচ্ছ জলে।

-ছোট্টো বোনটিকে কত আসা দিয়েছিল সে গগন চুম্বি বিরাট বিরাট বাড়ির সুসজ্বিত গৃহে রাখবে তাকে,হায়! বাড়ি তো দূরের কথা প্রাণে বাঁচাতে পারল না মিষ্টি বোনটিকে।

-নিজের অজান্তেই দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল রোদে পোড়া নিতাইয়ের গালে, গোধূলির শেষ আলোক কনা অনন্তের পথে পাড়ি দিতে প্রস্তুত, স্রোতস্বিনী গঙ্গা ও প্রবল বেগে ধেয়ে চলেছে ওই পথে,আর স্থির থাকতে পারল না নিতাই, পাঁচ টাকার মুঠি শক্ত করে ধরে পা বাড়াল সেই পথে মূহুর্তে মিশে গেল তাদের সাথে।

-আলোয় ঝলমল করে উঠল চারিপাশের বিরাট বিরাট গগন চুম্বি ইট পাথরের বাড়িগুলো।।

-দীপঙ্কর সরদার।।

⊂⊃⊂⊃⊂⊃⊂⊃⊂⊃

লেখক পরিচিতি-

আমি দীপঙ্কর সরদার,বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের দঃ২৪ পরগনা জেলার সুন্দিপুকুরিয়া গ্ৰামের বাসিন্দা, ছোটো থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষ হয়ে ওঠা,বড়ো জেঠ্যু কে দেখে কবিতা লেখার হাতে খড়ি,সরে ছোটো গল্প,প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি লিখতে থাকি,বর্তমানে নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজে পাঠরতা,বাবা,মা-অরবিন্দ সরদার ও নয়নতারা সরদার।

Leave a comment.

Your email address will not be published. Required fields are marked*