অণুগল্প

বেগুনী ফুল

-শ্যামল কুমার মিশ্র

∞∞∞∞∞∞∞∞∞∞∞∞

ঠিক এই সময়টাই অমলের পছন্দ। সূর্য তখন ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমাকাশে পাড়ি জমিয়েছে। সারা আকাশ জুড়ে রঙের খেলা। মা কাকিমারা সারাদিনের কাজকর্মের পরে ক্লান্ত শরীরে আঁচল বিছিয়ে গভীর ঘুমে। অমল সেই ঘুমের বাড়ি থেকে রওনা হয় তার সেই ঘোমটায় মুখ ঢাকা পুষ্করিণীর দিকে। খিড়কির দরজার খিলটা আলতো করে খুলে ফেলে অমল। দুষ্টু মেনিটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে পায়ে পায়ে জড়াচ্ছে আর ম্যাও ম্যাও করছে। অমল নীরবে ওর দিকে কড়া দৃষ্টিহেনে দরজার বাহিরে আসে।

সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। সকাল থেকে পড়তে পড়তে অমল বারংবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই কচুরিপানায় ঘেরা পুকুর। খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে সামনের দিকে এগোলেই ইটের রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। দুদিকে বড় বড় শিমূলের আর ছাতিমের সারি। এ রাস্তা বড় চেনা অমলের। রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে সেই পুকুরটিতে। পুকুরটির চারিদিকে প্রচুর গাছ। পশ্চিম পাড়ে ঘন বাঁশের বাগান।শান বাঁধানো ঘাটটিতে গিয়ে বসে অমল। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ঘন কালো জলের দিকে। দু একটা মাছরাঙ্গা জলের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। মাছ শিকার করতে করতে আড় চোখে তারা অমলকে দেখে নিচ্ছে। হঠাৎ অমলের দৃষ্টি আটকে যায় একটি কচুরিপানাতে। মাধ্যমিকের জীবন বিজ্ঞানের দৌলতে কচুরিপানার অভিযোজন তার জানা। কী সুন্দর বেগুনী রংয়ের ফুল ফুটেছে। তেরছা সূর্য রশ্মি এসে পড়েছে ওর গায়ে। দু একটি প্রজাপতি ফুলের গায়ে উড়ে এসে বসছে। অপূর্ব এক রূপবৈচিত্র্য ফুটে উঠছে। অমল লক্ষ্য করল কচুরিপানার একটি পাতা এসে যেন আড়াল করছে ফুলটিকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন সাপ তার ফনা তুলে রয়েছে। নিমেষেই অমল হারিয়ে যায় শৈশবের দিনগুলোতে। চৌকাঠের কাছে জন্মাষ্টমীর দিনে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথা পাঠে রত মা। ছোট্ট অমলের কথায় মন নেই। বিস্ফারিত নেত্রে সে দেখছে বইটার উপরের ছবিটিকে। একটি শিশু কোলে ব্যক্তিকে প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে আড়াল করে রয়েছে একটি বিরাট সাপ। সে তার ফনা তুলে যেন ছাতার মত ব্যক্তির মাথায় ধরে রয়েছে। মা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছবিটিকে প্রণাম করছে।

আর একটু বড় হয়ে অমলের মনে হয়েছে এর পেছনে ঈশ্বরীয় তত্ত্ব যাই থাকুক প্রকৃতি তার মতো করে পরস্পরকে রক্ষা করে। সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে প্রাণের খেলা অন্তর্লীন রয়েছে। কোথাও পাতা ফুলকে রক্ষা করছে, আবার কোথাও অভিযোজিত কান্ড রক্ষা করছে প্রাণকে। আবার কোথাও জীবজগতের সঙ্গে প্রকৃতির এক অপূর্ব সংযোগ যেখানে পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায় বেঁচে রয়েছে। প্রকৃতির এ এক গভীর রহস্যকথা। পাতা,ফুল,ফল,দ্বিরেফ,প্রজাপতি, জল সব নিয়ে জীবনের এক গভীর রহস্যময়তা।

কতক্ষণ তন্ময় হয়েছিল মনে নেই অমলের। সম্বিত ফেরে সুধার ডাকে। সে বলে—তুমি যাবে না অমল? দূরে ওই ধূপগুড়ির মাঠে যেখানে ঠাকুরদা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কত ফুল তার সাজিতে। আমি তার কাছে যেতে সে আমার খোঁপায় একটা ফুল গুঁজে দিয়ে বলল– অমলকে বোলো আমি ওর জন্য অপেক্ষায়।

অমল দেখল দুই বিনুনির ছোট্ট মেয়েটি যেন কখন বড় হয়ে গেছে। ওর খোঁপায় গোঁজা কচুরিপানার সেই বেগুনী ফুল— আইকরণিয়া এসিপিস। এক অপূর্ব রূপময়তা সুধাকে ঘিরে। সুধা হাতটা বাড়িয়ে দেয়। দুজনে এগিয়ে চলে ধূপগুড়ির মাঠের দিকে। চকিতের অবলোকনে হাজারো বেগুনী ফুল ঝরে পড়ে সমস্ত রাস্তা জুড়ে। অমল দেখছে সুধা কখন যেন আইকরণিয়া হয়ে গেছে…

∞∞∞∞∞∞∞∞∞∞∞∞

কবি/ লেখক পরিচিতি:

সাহিত্যকে ভালোবেসে কিছু লেখার চেষ্টা। কখনো তার প্রকাশ কবিতা, অণুগল্প কিংবা প্রবন্ধে। পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত প্রান্তে আমার জন্ম। গ্রামবাংলার মেঠোপথে কেটেছে শৈশব। তারপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন। লেখার অভ্যাস সেই ছোটবেলা থেকে। রামকৃষ্ণ মিশনে তা এক ভিন্ন মাত্রা পায়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার আয়োজিত বিদ্যাসাগর প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় দুবার বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র শ্রদ্ধেয় সন্তোষ কুমার অধিকারীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে। শিক্ষকতাকে ভালোবেসে প্রায় ৩৪ টা বছর কেটে গেছে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে অন্যতম প্রাপ্তি “দ্রোণাচার্য্য” পুরস্কার। ভালো লাগে পড়তে, লিখতে আর মানুষের মাঝে সময় কাটাতে। আর তাই সৃষ্টি “মনীষী চর্চা কেন্দ্রের” যা মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান ভিত্তিক মনন গড়ে তুলতে সদা সচেষ্ট। সাহিত্যের মাঝে বুক ভরে শ্বাস নেওয়াতেই আমার আনন্দ …

 

 

 

Leave a comment.

Your email address will not be published. Required fields are marked*