ছোট গল্প
মধুর শাসন
-মোঃ হাবিবুর রহমান
≈≈≈≈≈≈≈≈≈≈≈
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর স্কুলে গিয়েছি। একদিনের জন্যেও স্কুল কামাই দেইনি। কিন্তু প্রতিদিন যেতে যেতে মনটা কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। কিছুতেই কিছু ভালো লাগছিল না আমার। তাই ঐদিন রাতেই ভেবে নিলাম, আগামীকাল কিছুতেই স্কুলে যাবো না। একদিন না হয় জিরিয়ে নিব ক্ষণ।
ছাত্র হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না আমি। প্রতি ক্লাশেই প্রথম হতাম। একাত্তরের আগের কাহিনী। তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আমি। চৈত্রের শেষ। সকালে নাস্তা সেরে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছি। বেলা যত উপরে উঠছে রবির তেজও যেন তীব্র হতে লাগলো। প্রতিদিন দশটার দিকে গোছল করে কাপড়-চোপর পড়ে কিছু একটা মুখে দিয়েই স্কুলে যেতাম। কিন্তু ঐদিন স্কুলে না গিয়ে বন্ধুদের সাথে চকের মাঝখানে একটি পুকুরপাড়ে যাই। সেখানে অনেক রকমের গাছগাছালি। আম গাছ ছিল গোটা দশ বারো। বন্ধুদের সাথে গাছে ঝুলাঝুলি করি আর কাঁচা আম খাই। কখন যে বেলা গড়িয়ে পশ্চিমে হেলেছে, খেয়ালই করিনি। হঠাৎ মনে হলো আজ তো স্কুলে যাইনি, মা আমাকে আস্ত রাখবে না। জানি না কপালে কি আছে। ভাবলাম, এখন বাড়ি যাবো না। কিন্তু পেট তো আর তর সইছে না। ক্ষুধা যেন ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। কিন্তু মায়ের শাস্তির ভয়ে বাড়িমুখো হচ্ছি না।
ওদিকে আছরের আযান হচ্ছে। বন্ধুরাও যে যার মতো বাড়ি চলে গিয়েছে। বাড়ির দিকে তাকাতেই দেখি দূরে আমার বড় মজিবুর রহমান হাওলাদার (নয়াভাই বলে সব সময় যেকে থাকি তারে) পুকুরের দিকেই আসছে। ভয়ও করছে আবার শান্তনাও পাচ্ছি। বলতে বলতেই ভাই এসে হাজির। কোন রকম ভয় না দেখিয়ে ভাই বললো,” তুই কোথায় ছিলি, খাবি না কত বেলা হয়ে গেল বাড়ি যাস না কেন? মা কিন্তু অনেক চিন্তা করতেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। বলেই আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। কোন রকম ভয় না দেখিয়ে বরং যেতে যেতে আমাকে সাহসই দিচ্ছিল। ভাই আরও বললো, এ বাড়ি ওবাড়ি সব জায়গায় খুঁজেছি তোকে। কেউ কিছু বলতে পারেনি। ভাবলাম, পুকুরপাড়ে থাকতে পারিস। তাই চলে এলাম।
বাড়িতে তখন থমথমে অবস্থা। যেন পিন পতনের ক্ষীণ আওয়াজও নেই। ”নাইতে যা, থাবি না? খাওয়ার তো সময় নাই” নীচু স্বরে মা বললো। মনে হলো স্কুল কামাই করা মায়ের কাছে তেমন কোনো বিষয়ই না। কিন্তু আমার বড় দুই ভায়ের স্ত্রী ছিল। আর ঐদিন আমার মেজো বোনও বেড়াতে এসেছিল। তিনজনে মিলে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। তখনও জানতাম না আমার জন্যে কি কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।
গোছল করে এলাম। তেল পানি নিলাম। খাবারের ওখানে গেলাম। আমার দুই ভাবী ও মেজো বোন তারাও আছে। মা এসেই বললো, বড় বউ, একটা ছালার (চটের) বস্তা আনো তো। সাথে সাথে বড় ভাবী একটি বস্তা নিয়ে হাজির। মেজো ভাবীকে বললো, ওর জন্যে ভাত আনো। দেখি দু’টি থালায় কি যেন এনেছে। দু’ ‘টিতেই ঢাকনা দেওয়া। মায়ের কথা মত ঢাকনা উঠানো হলো। একটিতে ভাত আর অন্যটিতে ছাই রাখা হয়েছে। মা আস্তে আস্তে বললো, “ভাত খাবি নাকি ছাই খাবি? যদি স্কুল কামাই না করিস, তবে ভাত খাবি আর যদি স্কুল কামাই করিস তবে ছাই খাবি। এখন তুই-ই বেছে নে, কি করবি? আমি নির্বাক। কিছুই মাথায় আসছে না। এতো আদর করে এনে ছাই খেতে দিল। আমি কি সব সময় স্কুল কামাাই করি। মাত্র একদিনই তো কামাই দিয়েছি। তাতেই এতো বড় শাস্তি? তীব্র অভিমান করে মনে মনে কথাগুলি আওড়ালাম। কিছু যখন বলছি না, মা এবার চিৎকার করে বললো,”তাড়াতাড়ি কর যা করতে চাস। হয় ভাত খাবি, নয় তো এই বস্তাতে ভরেই তোকে পানিতে ডুবাবো। দেখি কি করে বাঁচিস। আমার ভয়ও করছে আবার জিদও চাপছে। ভাবীরা মাকে শান্তনা দিচ্ছে, ছোট ভাইজান আর কোনদিনও স্কুল কামাই করবে না। এখনকার মতো মাফ করে দেন। বুজিও মাকে শান্ত থাকতে বলে। কিন্তু মা কিছুতেই আমাকে ছাড়ছে না। মা আমাকে পানিতে চুবিয়েই ছাড়বে । যাহোক অবশেষে আমি স্কুলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভাত খেলাম। তবুও যেন ঘরের থমথমে ভাবটা কাটছে না।
আমার মায়ের অক্ষর জ্ঞান ছিল না। কিন্তু আমাদের লেখা-পড়ার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কোনোই কমতি ছিল না। বরং আগ্রহটা তীব্রই ছিল। নিজে না খেয়ে, রাত জেগে আমাদেরকে পড়িয়েছে মা। পড়ালেখার প্রতি কতটা অনুরাগ থাকলে একজন মা সেরকম শাস্তি দিতে পারে। স্কুল কামাইয়ের কুফল সম্মন্ধে আমার মা’র স্পষ্ট ধারণাই ছিল। তারপর বিনা কারণে কোনো দিনও স্কুল কামাই করিনি। আর মায়ের দেওয়া সেই শাস্তির কথা আজও ভুলি নাই। ভুলবোও না কোনদিন।
≈≈≈≈≈≈≈≈≈≈≈
পরিচিতি:
কবি মোঃ হাবিবুর রহমান। জন্ম ১৯৬১ সনের ২৫ অক্টোবর, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলাধীন কুমড়াখালী গ্রামে। গ্রামেই বেড়ে ওঠা। গ্রামের পাঠ শেষ করে দর্শন শাস্ত্রে সম্মান ও এমএ ডিগ্রী অর্জন করি। ঈষাখাঁ’র রাজধানী সোনারগাঁয়ের মেয়ে বিয়ে করি। আমাদের একটি মেয়ে সন্তান ও একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে চাকরি করেছি। অবসরে আছি। তাই, কবিতা ও গল্প লিখি। বর্তমানে ঢাকা শহরে শেওড়াপাড়া এলাকায় অবসর জীবন কাটাচ্ছি।