অনুগল্প

এতিম (নিশিকুমারী)

-রাজীব কুমার দাস

≈≈≈≈≈≈≈≈≈≈

পৃথিবীতে কিছু মানুষ সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় যাদের না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যায় অনায়াসে তারই একটি এই অর্ঘ। এতিম কী জিনিষ তার জানতে হবে নতুবা তার অভিমানের প্রাচীরটা ভাঙ্গা যাবে না।

“আপনি এতিম। কত সহজে বলে ফেললেন। বাবা মায়ের সাথে মতানৈক্য বা দূরত্বকে এতিম বলে না অর্ঘ। চলুন আজ আমার এতিম হওয়ার বিষয়টা বলি-

বাবা-মাকে জন্মের পর কখনও দেখিনি। আমার কাছে তাদের কোন ছবিও নেই যে দেখে বুঝতে পারবো আমি এদেরই অংশ। শুনেছি আমায় কুড়িয়ে পেয়েছিল পথে। জাতী-ধর্ম-বর্ন কিছুই নেই। বড় হয়েছি ছোট্ট একটা এতিমখানায়। নুতন জামা কেমন হয় জানতাম না। কোথাও থেকে কোন জামা সংগ্রহ করতে দিলে তা আমাদের পড়তে দিতো। কখনও গায়ের জামা পঁচে গন্ধ বের হয়ে যেত, বিভিন্ন জায়গায় ছিঁড়ে যেত। খাবারের বিষয়ে ছিল আরেক যুদ্ধ। কোন দয়াবান যদি কিছু দিয়ে যেত তাহলে সেটা আমাদের জন্য ছিল উৎসবের মতো।

আমাদের এতিমখানা থেকে দূরে একটা কমিউনিটি সেন্টার ছিল যেটায় প্রায়ই কোন না কোন অনুষ্ঠান হয়। তখন আমি অনেক ছোট। এতিমখানার কয়েকটা বাচ্চা বললো-চল সেখানে যাই। ওখানে যারা যায় তারা অনেক দামী দামী খাবার খায়। লোভে পড়ে আমিও তাদের সাথে চলে যাই। সেন্টারে ঢুকতেই পোলাও এর গন্ধে নাখ-মুখ একাকার হয়ে গেল। একটা কোনে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অপেক্ষায় ছিলাম কখন অনুষ্ঠান শেষ হবে আর টেবিলের উচ্ছিষ্টগুলো আমাদের দিয়ে দিবে। হঠাৎ একটু দূরে নজর যায় এক মা তার সন্তানকে পোলাও মাংস মেখে খাইয়ে দিচ্ছে, আদর করছে, চুমু খাচ্ছে। সেই মাকে দেখে পোলাও মাংসের লোভটা হারিয়ে গেলে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো আমারো একটা মা থাকতো। মা টা এভাবেই আমাকে আদর করে খাইয়ে দিত। এতিমখানায় আমরা মা সম্পর্কে যে যার মতো করে ভাবতাম কল্পনায়, কখনও দেখিনি। এই মাকে দেখে লোভটা সামলাতে পারিনি। একপা-দুপা করে এগিয়ে গিয়ে তার পায়ের কাছে বসে পড়লাম। মায়ের শরীরে কী মিষ্টি একটা গন্ধ। মা পরীর মতো। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিলো ছুঁয়ে দেখি। আমাকে পাশে বসতে দেখে ভদ্র মহিলা একটু নড়েচড়ে বসেন। ভয়ে ভয়ে হাতটা তার পায়ের কাছে নিয়ে পায়ের পাতাটা স্পর্শ করি অমনি মহিলা চোর চোর বলে চিৎকার করে। পাশে থাকা সিকিউরিটি এসে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দরজার বাইরে। রাস্তায় পড়ে আমার মাথাটা ফেটে যায়। অমনি অতিথিদের মাঝে থাকা এক ভদ্রমহিলা আমায় কলে তুলে নেয় তারপর আর মনে নেই আমি অজ্ঞান ছিলাম। চোখ খুলে দেখি আমি এতিমখানার বেঞ্চিতে শোয়া মাথায় ব্যান্ডেজ। উঠে বসতেই মহিলা আমায় কিছু খাবার দিয়ে চলে যায়।

পরদিন সকালে এতিমখানার ম্যানেজার এসে আমায় বলে- তোর জন্য নতুন মা এনেছি, সে তোকে নিতে এসেছে। আমি পাগলের মতো ছুটে যাই। সকলকে বলি-আমার মা আছে, পুরো এতিমখানায় খুশিতে দৌঁড়ে দৌঁড়ে চিৎকার করে বলতে থাকি আমার মা আছে। সকলে আমাকে ঘিরে থাকে আমি তখনও চিৎকার করে বলতে থাকি- আমার মা আছে।

ওদের সকলেরই ছিল মন খারাপ কারণ ওদের তখনো কোন মা নেই।।

≈≈≈≈≈≈≈≈≈≈

“লেখক পরিচিতি”-

জন্ম ৩১ ডিসেম্বর একান্নবর্তী এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী ও মা গৃহিনী। শৈশবে মায়ের কাছেই হাতেখড়ি তারপর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেড়িয়ে রসায়ন বিভাগে গ্রাজুয়েশন করেন। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে একটা স্কুল এন্ড কলেজে পার্টটাইম শিক্ষকতা (রসায়ন) করেন। ২০১০ এ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চাকুরীতে যোগ দিয়ে তিনি কর্মজীবন স্থির করেন এবং ২০১৩ এ এম.বি.এ (ফিন্যান্স) ডিগ্রি লাভ করেণ। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার পাশপাশি বই পড়া ছিল শখের বিষয়। সম্প্রতি ২০২৩ এ প্রকাশিত হয় উপন্যাস নিশিকুমারী এবং ২০২৪ এ নিকুঞ্জ নিকেতন।

Leave a comment.

Your email address will not be published. Required fields are marked*