রাক্ষুসে বন্যা

-রাজীব কুমার দাস

≈≈≈≈≈≈≈≈

শুনেছি প্রকৃতিও কখনও শোধ নেয়। আগষ্টের মাঝামাঝি সময় তখন ভরপুর বর্ষা। বাংলাদেশ-ভারত-চীন সবখানেই মৌসুমী বৃষ্টি হচ্ছে। রাতের বেলায় তখনও মানুষগুলো অজানা ছিল আগামীতে কী হতে যাচ্ছে! এমনিতে দু-চার ঘন্টার বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে অথচ মুষলধারে তিনদিন টানা বর্ষনে রাস্তাঘাট টইটুম্বুর। বাজারে গেলে শোনা যায় উজানের ঢল আসছে। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় হঠাৎ শোনা যায় শোরগোল। হরপ্রসাদ বাইরে বের হয়ে এসে দেখে উঠোন জুড়ে পানি। পাশের বাড়ীর মজিদভাই তার পরিবারের সকলকে নিয়ে বের হয়েছে।

“মজিদভাই কৈ যাও?”

“উজানের পানি আমাগো গেরামে ডুকি গেসে হরপ্রসাদ যত তাড়াতাড়ি পারো বউ-বাচ্চালই রেলরাস্তার দিকে যাও। পরশুরাম বাজার ডুবি গেসে।” কেমন যেন বিশ্বাস হয়নি। এর আগেও তো নদীতে বান এসেছে কিন্তু এমন হয়নি। ঘরে ঢুকতেই দেখে চৌকাঠ দিয়ে হনহনিয়ে ঢলের পানি ঢুকছে। ছেলেমেয়েকে নিয়ে এক কাপড়ে বাইরে বের হয়। চিড়ামুড়ি কিছু পলেথিনে নেয় কিন্তু যাবে কোথায়? বাঁধের উপর হাজারো মানুষের ঢল। অল্প সময়ের মধ্যে পানি কোমড় ছুঁয়ে গলা অব্দি।

আমেনা স্রোত ঠেলে এগোয় আশ্রয়ের খোঁজে। ১১বয়ছ বয়েসী বড়মেয়ের কোলে আড়াই বছরের জামাল আর মজিদ আমেনার হাত ধরা। কিছুদূর এগোতেই আমেনার মেয়েটা স্রোতের টানে পড়ে যায়। পাশ দিয়ে ভেসে যাবার সময় মা মেয়েকে টেনে ধরলো কিন্তু জামালকেতো আর দেখা যাচ্ছে না। মেয়েকে বাঁচাতে পারলেও বানের টানে ভেসে গেল জামাল। চাইলেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা আর খুঁজতে গেলে এদের বাঁচানো যাবেনা। নাড়ছেড়া ধনকে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে এগোয় বাঁধের দিকে। কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে আসে অনেকে।

একদিকে মুষলধারে বৃষ্টি অন্যদিকে বন্যার পানি। মাটির ছোঁয়াও পাওয়া যায়না। এদিকে হারাধন ও তার স্ত্রী মেয়ে ও অসুস্থ্য ছেলেকে নিয়ে একটা বটগাছের ডালে ভেসে এসে থামে। ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, সারাশরীর ভেজা। গাছের ডালে বসে অপেক্ষা করছে-কেউতো আসবে উদ্ধার করতে! কিন্তু তিন বেলা কেটে গেল কেউ আসছে না। সন্ধ্যার পর হঠাৎ ছেলেটা খিচুনি দিয়ে নিমিষেই স্থির হয়ে যায়। শত চেষ্ঠা করেও হারাধন বাঁচাতে পারলো না ছেলেকে, চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সকলে। চারদিকে অথৈই পানি লাশ সৎকার করবে কীভাবে। ভোর অব্দি নিথর দেহটা মমতায় আগলে রেখে অবশেষে ভাষিযে দেয় চোখের জলে বানের পানিতে।

সেদিন অসহায় ছিল হরপ্রসাদ-হারাধন-মজিদ-আমেনারা। অবিনাশী বানের পানি তখন কোন জাত দেখেনি সম্প্রদায় দেখেনি, যেখান দিয়ে গেছে সবকিছু ডুবিয়ে ভাষিয়ে নিয়ে গেছে। সম্প্রদায়ের লড়াই তো আমরা সকলেই লড়ি প্রকাশ্যে নতুবা আড়ালে অথচ সেদিন কোন সম্প্রদায় ডুবেনি, কোন হিন্দু বা মুসলিম ডুবেনি। সেদিন ডুবেছিল কিছু মানুষ ও তার মনুষত্য। সেদিন যারা ডুবেছিল তারা বাংলাদেশী।

≈≈≈≈≈≈≈≈

কবি পরিচিতি-

জন্ম ৩১ ডিসেম্বর এক মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারে। বাবা সরকারী চাকুরে এবং মা গৃহিনী।শৈশবে মায়ের হাতেই হতেখড়ি তারপর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের পথ পেড়িয়ে রসায়নে সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করতেই একটি স্কুল এন্ড কলেজে পার্টটাইম (রসায়ন)শিক্ষকতা করেন এবং পরবর্তীতে এমবিএ (ফিন্যান্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার পাশাপাশি বই পড়া ছিল অন্যান্য শখগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১০ এ একজন সরকারী চাকুরে হিসেবে নিজেকে স্থীর করেন এবং কবিতা ও অনুগল্প নিয়ে লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। সম্প্রতি বইমেলা-২০২৩ ও ২০২৪ এ প্রকাশিত হয়েছে দুটি সমকালীন উপন্যাস নিশিকুমারী ও নিকুঞ্জ নিকেতন। মিশুক স্বভাব ও ভ্রমন পিপাসু মনের জন্য তিনি শুভাকাঙ্খি ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে বেশ প্রশংসিত

Leave a comment.

Your email address will not be published. Required fields are marked*